হাশিম আমলা : ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ

হাশিম আমলা, বিশ্ব ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো এক সময়ের তারকা ক্রিকেটার। আমলা নিজের ব্যটিং নৈপুণ্যের কারণে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেকে এক ব্যাটিং কিংবদন্তীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। দিনের পর দিন ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে কুড়িয়ে গেছেন ক্রিকেট মহলের প্রশংসা। দুর্দান্ত ব্যাটিং ছাড়াও, নিজের অসাধারণ আচরণবিধির কারণে বহুবার থেকেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে।

 

হাশিম আমলাঃ ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ
টেস্ট জার্সি গায়ে হাশিম আমলা

 

দক্ষিণ আফ্রিকার এই কিংবদন্তী ব্যাটার জন্মগ্রহণ করেন ডারবানে, ১৯৮৩ সালের ৩১শে মার্চ। তার পূর্বপুরুষরা অবশ্য ভারতীয়। তার দাদা ছিলেন গুজরাটের সুরাট শহরের বাসিন্দা এবং তার দাদার তিন ছেলের তিন জনই থাকেন তিন দেশে। এদের মধ্যে হাশিম আমলার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকায় আর বাকি দুই ভাইয়ের একজন আমেরিকা আর অন্যজন থাকেন বাংলাদেশের ঢাকায়।

[ হাশিম আমলা : ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ ]

স্কুলে থাকা অবস্থা থেকেই ক্রিকেটে দুর্দান্ত ছিলেন আমলা।  যার সুবাদে ২০০০-০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অনুর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান তিনি এবং ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের কারণে ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অনুর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হন তিনি।২০০৪-০৫ ক্রিকেট বর্ষের প্রথম ৮ ম্যাচে ৪ সেঞ্চুরির দেখাও পান আমলা যার সুবাদে ডাক পান ভারতের বিপক্ষে জাতীয় দলের সিরিজে।

২০০৪ সালের ২৮শে নভেম্বর প্রথমবারের দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন হাশিম-আমলা। সে টেস্ট ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ২৪ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ২ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেননি আমলা। একই বছর  ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২ টি টেস্ট খেললেও ব্যার্থ ছিলেন সেখানেও। ২ টেস্টে সর্বোচ্চ  ইনিংসটি ছিলো মাত্র ২৫ রানের।

পরে আবারো দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে সুযোগ পান প্রায় দেড় বছর পর। ২৭ এপ্রিল ২০০৬, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবার মাঠে নামেন আমলা, ৬ ঘন্টা ৪৮ মিনিট মাঠে থেকে ৩১৭ বল খেলে রান করেন ১৪৯। সেখান থেকে শুরু, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার এই তারকা ব্যাটসম্যানকে। ক্যারিয়ার শেষে ১২৪ টেস্ট খেলে ৯,২৮২ রান করে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ২য় সর্বোচ্চ টেস্ট রান সংগ্রাহক হিসেবে। তার উপরে আছে শুধু জ্যাক ক্যালিস।

একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ত্রিপল হান্ড্রেড আছে আমলার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ জুলাই ২০১২ তারিখে সিরিজের প্রথম টেস্টের ৪র্থ দিনে এই মাইলফলকে পৌঁছান আমলা। অপরাজিত ৩১১ রানের ইনিংসে আমলা বল মোকাবেলা করেছেন ৫২৯ টি আর ব্যাটিং করেছেন প্রায় ১৩ ঘন্টা ১০ মিনিট ব্যাপী।

হাশিম আমলার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিলো ২০১০ থেকে ২০১৪। এই সময়ে আমলা মোট ৪২ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ৬৫.৬২ গড়ে। শতক সংখ্যা ১৬, মোট রান ৪,০৬৯। জানুয়ারি ২০১০ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে অন্তত ২,০০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আমলার গড় ছিলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৬৭.৭১ গড় নিয়ে চন্দরপল ছিলেন তার উপরে আর ৬৪.৪৩ গড় নিয়ে ৩ নম্বরে কুমার সাঙ্গাকারা।

 

হাশিম আমলাঃ ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ
২০১১ বিশ্বকাপে হাশিম আমলা

 

ওডিআই ক্রিকেটে হাশিম-আমলা ২০১৮ এর আগ পর্যন্ত ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওডিআই ক্রিকেটে দ্রুততম ২০০০, ৩০০০, ৪০০০, ৫০০০, ৬০০০ আর ৭০০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনিই। ২০১০ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৭ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ফরমেটে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের তালিকায় আমলার অবস্থান দুইয়ে। তার উপরে আছে শুধু ভিরাট কোহলি। তবে কোহলি আমলার থেকে ৪৭ টি ইনিংস বেশি খেলেছিলেন।

হাশিম-আমলা মোট ১৮১ ওডিআই খেলে ৪৯.৪৬ গড়ে রান করেছেন ৮,১১৩ এবং ১২৪ টেস্ট খেলে রান করেছেন ৯,২৮২, গড় ৪৬.৬৪। এই দুই ফরমেটে একই সাথে ৮০০০ এর উপরে রান আর ৪৫ এর বেশি গড় আছে শুধু দুইজনের। প্রথমজন তারই স্বদেশী এবিডি ভিলিয়ার্স আর পরের জন আমলা নিজেই।

 

হাশিম আমলাঃ ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ
আইপিএলের জার্সি গায়ে হাশিম আমলা

 

হাশিম আমলা শুধু টেস্ট আর ওডিআই না, টি২০ তেও সমানভাবে সফল ছিলেন, ছিলেন কার্যকরীও। ১৩০ এর উপরে স্ট্রাইক রেটে টি২০ ফরমেটে ১০০০ রান আছে মাত্র ৪ জন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানের। হাশিম আমলা তাদের মধ্যে একজন। ৪৪ ম্যাচে ৮ অর্ধশতক, ১৩২.০৫ স্ট্রাইক রেট আর ৩৩.৬০ গড়ে মোট রান করেছেন ১,২৭৭। সর্বোচ্চ ইনিংসটি অপরাজিত ৯৭ রানের।

অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়কত্ব তো পেয়েছিলেন একেবারে শুরু দিকেই, ২০০২ সালে। ২০১১ এর জুনে দক্ষিণ আফ্রিকা ওডিআই এবং টি-টোয়েন্টি দলের সহ-অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান। সেখানে থেকেই ২ টি টি২০ এবং ৯ টি ওডিআই ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন আমলা। এরপর স্বেচ্ছায় সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।

২০১৪ সালে পান টেস্ট দলের দায়িত্ব। তার অধিনায়কত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা খেলে মোট ১৪টি টেস্ট। এই ১৪ টেস্টে ৪ জয় আর ৬ ড্র এর বিপরীতে দল হারে ৪ ম্যাচ। অধিনায়ক হিসেবে হাশিম আমলার ব্যাক্তিগত পরিসংখ্যানও ছিলো ভালো। ৪৯.৬৬ গড়ে এই ১৪ ম্যাচে আমলা রান করেন ৮৯৪।

 

হাশিম আমলাঃ ধারাবাহিকতার এক নম্রতম সংস্করণ
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেঞ্চুরির পর হাশিম আমলা

 

হাশিম আমলা মোট ১২৪ টেস্টে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েছেন ২৮ বার, ওডিআই এর ১৮১ ম্যাচে ছুঁয়েছেন ২৭ বার। আন্তর্জাতিক টি২০ তে না থাকলেও টি২০ ক্রিকেটে আমলার আছে ২ টি শত রানের ইনিংস। দুটিই আবার ২০১৭ আইপিএলে কিংস ইলেভেনের পক্ষে।

২৩৮টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে আমলার সংগ্রহ ৪৮.৫২ গড়ে ১৭ হাজার ৮০৯ রান, শতক ৫২ টি আর অর্ধশতকের সংখ্যা ৮৮। ২৪৩টি লিস্ট-এ ম্যাচে ৩০ শতক, ৫২ অর্ধশতক আর ৪৫.১২ গড়ে মোট সংগ্রহ ৯,৯৭৩ রান। লিস্ট-এ তে আর ২৭ রান করলেই ছুঁয়ে ফেলতেন ১০ হাজারের মাইলফলক।

হাশিম শুধু একটি নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের কাছে তিনি একটি আইকন। হাশিম আমলার দুর্দান্ত ব্যাটিং শৈলী এবং বিনয়ী আচরণের কারণে ক্রিকেট বিশ্ব তাকে যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment