আকসার আহমেদ : ভারতীয় চলচ্চিত্র “ইকবালের” এক বাস্তবিক রূপ ::::: মুখে নেই শব্দ, কানে নেই শ্রবণ শক্তি। কিন্তু, বাহুতে আছে জোর বুকে আছে তীব্র আত্মবিশ্বাস, বলছি বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী আকসারের কথা। আকসারের বোলিং ঝুলিতে রয়েছে সবকিছু, যা তাকে পরবর্তীতে দেশের এক অন্যতম সেরা পেস বোলার হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।আকসারের বাড়ি সিলেট।এক বোন এবং ২ ভাইয়ের মধ্যে আকসারই ছোট।বেসরকারি এক টেলিভিশন চ্যানেলের একটি প্রতিবেদন দেখে আকসারের প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারে বিপিএল ২০২২ এর দল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, এক বছর জুড়ে আকসারের জন্য সকল ক্রিকেটীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে দলটি। এ বছর চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের নেট বোলার হিসেবে কাজ করছেন আকসার। এবারের বিপিএলের পুরোটা সময় জুড়েই আকসার আছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স দলের সঙ্গে ।
[ আকসার আহমেদ : ভারতীয় চলচ্চিত্র “ইকবালের” এক বাস্তবিক রূপ ]
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাঁতো কেএম রিফাতুজ্জামান জানান, “আকসার আহমেদ এক বিস্ময় প্রতিভা। অমিত সম্ভাবনার এসব প্রতিভা অনেক সময়ই অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় বাঁধা হয় পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা এমন সম্ভাবনা হারিয়ে যেতে দিতে পারিনা। আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আকসারের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।“
আকসার বর্তমানে পেস বোলিং তালিম নিচ্ছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স বোলিং কোচ শন টেইটের কাছ থেকে।এছাড়াও, আকসারের ক্রিকেটীয় সকল স্কিল ট্রেইনের জন্য কাজ করছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স হেড কোচ পল নিক্সন।সব মিলিয়ে, সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছে আকসারের। আকসার চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স ডেরায় খুজে পেয়েছেন নিজের এক স্বপ্নের ঠিকানা। শুধু চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সই নয় আকসারের পাশে আছে দে্শের সিনিয়র ক্রিকেটাররা।
এরই মধ্যে মিরপুর একাডেমী মাঠে বোলিং অনুশীলনের সময় আকসারকে কিছু বোলিং কলাকৌশল শিখাচ্ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তজা। আকসারের বোলিংয়ে ইনসুইং, আউট সুইং সবই আছে। দ্রুত গতিতে বোলিং করার প্রবণতাও রয়েছে তার মধ্যে।১৩৮ গতিতেও বল করতে পারেন তিনি।
তাই তো, আকসারকে সকল প্রকার ক্রিকেটীয় তালিম সঠিক ভাবে বোঝানোর জন্য এবং তার মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য প্রতীকী ভাষা বোঝার এক্সপার্ট খুজছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স কোচ পল নিক্সন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি টুইটও করেছেন তিনি।
টুইটে নিক্সন বলেন,”আমাকে যারা ফলো করছেন, তাদের মধ্যে কি কোন কান বিশেষজ্ঞ আছেন? এমন কেউ থাকলে বিশেষ একজন তরুণের প্রসঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাই। যার সহযোগিতা বেশ প্রয়োজন।”
ক্রিকেট এখন পর্যন্ত আকসার আহমেদের এই পথযাত্রা যেন কোনো হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য এক সংগ্রামী নায়কের মতো। ২০০৫ সালে ভারতে মুক্তি পায় “ইকবাল” নামের এক চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের নাম ইকবাল, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রেয়াস তালপাডে। ইকবালের পরিবার একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো কৃষি কাজের মাধ্যমে।
ছোটবেলা থেকেই ইকবাল ভারতীয় ক্রিকেটের ফ্যান ছিলো। সে বরাবরই স্বপ্ন দেখতো ভারতের জার্সি গায়ে তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। তাই মাঠে ঘাটে সব জায়গায়ই সে নিজের বোলিং কে শাণিত করার লক্ষ্যে মেতে থাকত। তার সংগী ছিলো একটি ক্রিকেট বল এবং ৩ টি পুরনো লাকড়ি যেটি মাটিতে স্ট্যাম্পরূপে পুতে সে বোলিং অনুশীলন করতো।
ইকবাল প্রতিদিন সকাল বেলা তার ঘরে পালা গরু গুলোকে, ঘাস খাওয়াতে গ্রামের এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো। তার গ্রামে একটি ক্রিকেট ক্লাব ছিলো যেখানে রোজ রোজ খেলোয়াড়েরা ক্রিকেট অনুশীলনে মেতে থাকত। প্রতিদিনই গরু চড়ানোর সময় ইকবাল, সে ক্রিকেটারদের অনুশীলন দেখতেন এবং সে ক্লাবের পাশেই একটা রাস্তায় সেও লাকড়িরূপি স্ট্যাম্প মাটিতে গেড়ে নিজের বোলিং অনুশীলন করতো। ইকবালের ক্রিকেটে এমন আগ্রহ দেখে, সে ক্রিকেট ক্লাবের কোচ তাকে বিনা অর্থে তাদের সাথে ক্রিকেট অনুশীলন করার সুবিধা দেয়।
কিন্তু, একদিন ক্রিকেট অনুশীলনের সময়, তার করা একটি বাউন্সার এক ব্যাটারের মাথায় আঘাত করলে তার কাছ থেকে ক্লাবে অনুশীলনের সুযোগ কেড়ে নেয়া হয়। তার গ্রামেই এক সাবেক রঞ্জী ট্রফি খেলা বোলার ছিলো যিনি প্রতিনিয়তই মদ্য পানে মেতে থাকতেন।
অবশেষে সেই মদ্যপায়ী ব্যাক্তিই ইকবালকে ক্রিকেট বোলিংয়ের তালিম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার অধীনেই ইকবাল বোলিংয়ের খুটিনাটি সকল বিষয় চর্চা করতে থাকে এবং নিজেকে একজন উপযুক্ত ফাস্ট বোলার হিসেবে গড়ে তোলে। এরই মধ্যে ইকবালের সুযোগ হয় রঞ্জি ট্রফি খেলার। সেখানে, সে চমৎকার বোলিং প্রদর্শনপূর্বক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান।
ভারতীয় এই “ইকবাল” চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের এক বাস্তব রূপই যেন সিলেটের আকসার আহমেদ। তার জন্ম সিলেটের গোলাপগঞ্জের বাদেপাশা ইউনিয়নের মোল্লারচকে এবং সেখানেই ছোট থেকে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মাত্র ২ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার ঝোক থাকার কারণে , তার মা দিলারা বেগম নিজের সর্বস্ব উজাড় করছেন যেন আকসার একদিন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
আকসাররা টিকে থাকে জীবন যুদ্ধে, জীবন যুদ্ধের প্রতিটি বাধা পেরিয়ে উদাহরণ হয়ে থাকে আধারে থাকা সেসব মানুষের জন্য যারা প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ করে যাচ্ছে এক টুকরো সোনালি আলোর মুখ দেখবে বলে। আকসার এগিয়ে যাবেন , প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাবেন নিজেকে এবং সাফল্যের উচ্চ শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এই যেনো সকলের প্রত্যাশা।