ওয়াসিম আকরাম : টেবিল টেনিস থেকে ক্রিকেট

বিশ্বের এমন কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকে দেখা যাবে না , যিনি ওয়াসিম আকরামকে চেনেন না। হ্যা, ক্রিকেটের সঙ্গে ওয়াসিম আকরাম এক প্রকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে রীতিমত খাবি খাইয়েছেন বিশ্বের নামিদামি ব্যাটারদের। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ড রয়েছে ওয়াসিমের।

[ ওয়াসিম আকরাম : টেবিল টেনিস থেকে ক্রিকেট ]

ওয়াসিম আকরামের বোলিংয়ে গতি থেকে শুরু করে অ্যাকুরেসি, সুইং সবই ছিলো। তার এসব গুণাবলিই তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে রুপান্তরিত করেছে।

 

ওয়াসিম আকরামঃ টেবিল টেনিস থেকে ক্রিকেট
১৯৯২ বিশ্বকাপে ওয়াসিম আকরাম

 

১৯৯২ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি। সে বিশ্বকাপের ফাইনালের ম্যান অব দ্যা ম্যাচও ছিলেন তিনি। সে বিশ্বকাপে সর্বমোট ১৮টি উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও তার বোলিং নৈপুণ্য পাকিস্তানকে সে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠিয়েছে।

 

ওয়াসিম আকরামঃ টেবিল টেনিস থেকে ক্রিকেট
১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়াসিম আকরাম

 

ওয়াসিম আকরামের জন্ম পাকিস্তানের একটা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। উনার বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন, তারই ইচ্ছায় ওয়াসিমকে লাহোরের একটা স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, ছোটবেলায় ওয়াসিমের আগ্রহ ছিল টেবিল টেনিসে। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি তার দাদার সাথে থাকতেন, যিনি একজন প্রচণ্ড ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন। দাদার আগ্রহে তার নিজেরও ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আস্তে আস্তে স্থানীয় ক্লাবে খেলা শুরু করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ক্লাবের একাদশেও শুরুতে তিনি সুযোগ পেতেন না।

পরবর্তীতে লাহোরে আয়োজিত একটা ক্রিকেট ক্যাম্পে বোলিংয়ের অডিশন দিতে যান ওয়াসিম। প্রথম দুই দিন বোলিং করার সুযোগই পাননি, কিন্তু তৃতীয় দিনে বোলিং করে চোখে পড়েন নির্বাচক হাবিব আহসানের যিনি কিনা পাকিস্তানের পক্ষে ১২টি টেস্টও খেলেছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন অধিনায়ক জাভেদ মিঁয়াদাদও প্র্যাকটিসে বোলিং দেখে ওয়াসিমকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়ে যান।

নিউজিল্যান্ড সফরের পাকিস্তান দলেই তার জায়গা হয়ে যায়। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে মাত্র দু’টি উইকেট পান, দলও হারে ইনিংস ব্যবধানে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টেই দুই ইনিংসে ৫টি করে উইকেট পান। তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ বোলার  হিসেবে এক ম্যাচে দশ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড করেছিলেন ওয়াসিম।

 

ওয়াসিম আকরামঃ টেবিল টেনিস থেকে ক্রিকেট
২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ওয়াসিম আকরাম

 

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল মিস করেন ইনজুরির জন্য, মনোবল হারিয়ে পাকিস্তানও হেরে যায় সেই ম্যাচে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও তিনি ১৫টি উইকেট পান এবং পাকিস্তান ফাইনালে যায়। ২০০৩ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচের ৫ ইনিংসে ১২ টি উইকেট পেলেও পাকিস্তান দল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। এই বিশ্বকাপের পরই পাকিস্তান দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে এবং অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারদের সাথে সাথে ওয়াসিম আকরামও দল থেকে বাদ পড়েন।

টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ওয়াসিম আকরাম ১৯৯৩ সালে ‘উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ নির্বাচিত হন।  এছাড়া উইজডেন দ্বারা নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে বোলার হিসেবেও নির্বাচিত হন ওয়াসিম।

টেস্ট ক্রিকেটে এই পর্যন্ত ৪৩টি হ্যাটট্রিক হয়েছে, ওয়ানডে ক্রিকেটে হয়েছে ৪৪ টি। আর ওয়াসিম আকরাম হচ্ছেন একমাত্র বোলার, যার টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দু’টি করে হ্যাটট্রিক রয়েছে। এর মাঝে ওয়ানডের দু’টো হ্যাটট্রিক সরাসরি বোল্ড করার মাধ্যমে।

প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট লাভ করেন ওয়াসিম আকরাম। পরবর্তীতে মুরালিধরন তার রেকর্ড ভাঙলেও আর কোনো ফাস্ট বোলার এই রেকর্ডের কাছাকাছিও এখনো যেতে পারেননি, অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

ব্যাট হাতেও লোয়ার অর্ডারে যথেষ্ট কার্যকরী ছিলেন। টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি রয়েছে, যার মধ্যে একটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছিলেন তিনি। এছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৫৭ রানের একটা ইনিংস খেলেন, যা কিনা আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এছাড়া সেই ইনিংসেই ১২টি ছক্কা মেরেছেন, যা কিনা এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড। পাকিস্তানি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এটাই।

 

Cricket GOLN-Website Logo-01

এছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রায়ই লোয়ার অর্ডারে নেমে ছোটখাটো ক্যামিও খেলে পাকিস্তানকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জয় এনে দিয়েছেন। ১৯৮৯ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত নেহেরু কাপের ফাইনালে ওয়াসিম যখন মাঠে নামলেন, তখন শেষ দুই বলে প্রয়োজন ছিল ৬ রান। ওয়াসিম আকরাম প্রথম বলেই ছক্কা মেরে পাকিস্তানকে এনে দেন ঐতিহাসিক জয়।
নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে এতো অর্জনের পরেও অনেকে একটা বিষয় জানলে অবাক হবেন যে ওয়াসিম আকরামের জীবনের লক্ষ্য ছিলো একজন টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হওয়া। এ বিষয়ে তার আত্মজীবনি ওয়াসিমে তিনি লিখেছেন,
” লাহোরে বসবাস ছিল আমাদের। বাবা ছিলেন খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রেতা। বাবা-মার চিন্তা ছিল শুধুই আমাদের পড়াশোনা নিয়ে। তাই যত সুযোগ-সুবিধা দেয়া সম্ভব তা দিয়ে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করালেন। ১২ বছর বয়সে আমি মায়ের সাথে থাকতে শুরু করি, নানির বাড়িতে। আমার বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে সবধরনের খেলাই খেলতাম। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায় যখন ক্লাস নাইনে উঠি।”

Leave a Comment