সাইদ আজমল, দুসরা শিল্পের এক কার্যকরী শিল্পী। এ দুসরা শিল্পের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাঘা বাঘা ব্যাটারদের পরাস্ত করেছেন সাইদ আজমল। তবে, দুসরা শিল্পের মাধ্যমেই সাইদ হারিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের প্রতিপত্তি।
ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলার সময় এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি একটি ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি হন। ১৯৯৩ সালে ১৬ বছর বয়সে ন্যাশনালে জিমখানা ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি হন আজমল। কোচ ওয়াকার আহমেদ খানের পরামর্শে অফ স্পিনার হিসেবে খেলা শুরু করেন।
২ জুলাই, ২০০৮। ভারতের বিপক্ষে করাচিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন সাইদ আজমল। ৩০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা দেন তিনি। যে বয়সে নিজের সেরা সময় কাটান ক্রিকেটাররা, সে সময়ে ক্রিকেট পাড়ার নতুন মুখ তিনি। ফ্লাইটে টপ স্পিন দিয়ে মাত দিচ্ছিলেন ব্যাটসম্যানদের! তাঁর বলে রান বের করাই যেনো বড় চ্যালেঞ্জ। বলে গতি থাকায় ব্যাটসম্যানের জন্য টিকে থাকা যেন অগ্নিপরীক্ষার মতো। সাথে গোপন অস্ত্র হিসেবে দুসরা তো ছিলোই!
[ সাইদ আজমলঃ এক আক্ষেপের নাম ]
অবশ্য এই দুসরা বল করতে গিয়ে বোলিং অ্যাকশনে সমস্যায় পড়েন তিনি। প্রশ্ন উঠে তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়েও! ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর একবার বোলিংয়ে নিষেধাজ্ঞাও পান! তবে পরীক্ষা দিয়ে টেস্ট উতরে আবার দ্রুতই ফিরেও আসেন তিনি। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির পর ওই বছরই তিনি টেস্টেও অভিষিক্ত হন।
২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলার সুযোগ হয় তাঁর। ওই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। এবং টুর্নামেন্টে ১২ উইকেট শিকার করে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন তিনি। ক্রিকেট দুনিয়ার কাছে একজন ‘মিস্ট্রি’ বোলার হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তাঁর ম্যাজিকেল বোলিং প্রশংসা পায় পুরো ক্রিকেট পাড়ায়।
পরের বছর ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দলের হয়ে ছিলেন সেরা বোলার। ৬ ম্যাচে শিকার করেছিলেন পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ১১ উইকেট! টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালের শেষ ওভারে মাইক হাসির তান্ডবে টানা দ্বিতীয়বার ফাইনাল খেলার স্বপ্নভঙ্গ হয় পাকিস্তানের।
ক্যারিয়ার শুরুর ৩ বছরের মাথায় ২০১১ সালে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ও গ্রায়েম সোয়ানদের টপকে ওয়ানডেতে বোলিং র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে আসেন সাইদ আজমল। টানা তিন বছর টপে থেকে ২২ গজে ত্রাস করেন তিনি।
২০১২ সালে টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়েও তিনি উঠে আসেন শীর্ষে। টেস্টেও ছিলেন সেরা তিনে! তিন ফরম্যাটেই বল হাতে রাজত্ব করছিলেন এই জাদুকরী স্পিনার। ওই বছর বিগ ব্যাশে অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। যে দুসরা দিয়ে বনে গেছিলেন রহস্যময়ী বোলার! সেই দুসরাই পরবর্তীতে ক্যারিয়ারে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে আবারো তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এরপর বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা দেওয়ার পর তা অবৈধ ঘোষণা করলে আবারও আইসিসি থেকে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। ৬ মাসের কাছাকাছি সময় ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার পর অ্যাকশনে খানিকটা পরিবর্তন এনে আবারো জাতীয় দলে ফিরেছিলেন তিনি। তবে আগের সেই জৌলুশটা হারিয়ে ফেলেছিলেন এই সময়ের ব্যবধানে। আজমলের বোলিংয়ে সেই জাদুটা আর দেখতে পারেনি ক্রিকেট সমর্থকরা।
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর আর সাদা পোশাক গায়ে জড়াতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে ১০ ওভারে ৭২ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি! ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে বোলিং ফিগারের পর জাতীয় দলে আর থিতু হতে পারেননি তিনি। ফেরার পর খেলেছিলেন মাত্র ২ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টি!
তিন আন্তর্জাতিক ম্যাচে শিকার করেছিলেন মোটে এক উইকেট, ইকোনমি রেট টাও ৭ এর কাছাকাছি। নিজেকে সময় দিবেন সেরা অবস্থানে ফিরতে সেই সময়টুকু অবশ্য পাননি আজমল। দল থেকে বাদ পড়লেন! এরপর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি।
৩৫ টেস্টে নিয়েছেন ১৭৮ উইকেট। পাঁচ উইকেট ১০ বার ও দশ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার! ১১৩ ওয়ানডে ম্যাচে শিকার করেছেন ১৮৪ উইকেট। ২ বার শিকার করেছেন ফাইফর অপরদিকে, ৬৪ টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ৮৫ উইকেট; একসময় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫৭২ ম্যাচে শিকার করেছেন প্রায় ১২০০ উইকেট! রঙিন পোশাকে ইকোনমি টাও ছিলো নজরকাড়া। ওয়ানডে মাত্র ৪.১৮ ও টি-টোয়েন্টিতে ৬.৫ ইকোনমিতে বল করেছেন তিনি!
যেই জাদুকরী ‘দুসরা’ বোলিংয়ে ক্যারিয়ারের উত্থান হয়েছিলো আজমলের। সেই দুসরাই পরবর্তীতে তাকে ছিটকে দেয় জাতীয় দল থেকে। অবশ্য এই জাদুকরী বোলিং দিয়েই ৭ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি বনে গেছেন পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনার। দেরীতে এসেছিলেন বলে আক্ষেপটা হয়তো আছে, থাকবে। কিন্তু বিদায়টা যে মোটেও সুখকর ছিলো না এই স্পিনারের!
এরপর, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে তাকে দলে সুযোগ করে দেয়া হয়। তবে, সে সিরিজে রীতিমত ব্যর্থ হন আজমল। এরপর, আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেখা যায়নি তাকে।
আরও পড়ুন: