মুত্তিয়া মুরালিধরন : দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম

হ্যা, সর্বকালের সেরা অফস্পিনারের প্রসঙ্গ তুললে সবার আগে আসবে মুত্তিয়া মুরালিধরনের নাম। নিজের স্পিন ভেল্কির মাধ্যমে বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটারদের আউট করে বহুবার আয়নাবাজি দেখিয়েছেন মুরালি। মুরালি শুধু একটি নামই নয়, বরং ৯০এর দশকের ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে এটি একটি আবেগের নাম।

তিনি টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেটের মাইলস্টোন অর্জন করেছেন যা সর্বকালের সেরা রেকর্ড। আর ওয়ানডে ক্রিকেটে তার উইকেট সংখ্যা ৫৩৪ টি যা ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট কোন এক বোলারের। তিনি ওয়ানডে আর টেস্ট ক্রিকেট মিলিয়ে ১৩৩৪ উইকেটের মালিক যা ক্রিকেট বিশ্বে প্রথম।

 

মুত্তিয়া মুরালিধরনঃ দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সময় মুরালি

 

মুরালিধরন জন্মগ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল ১৯৭২ সালে শ্রীলংকার ক্যান্ডিতে, শ্রীলংকার পার্বত্য অঞ্চলের এক তামিল হিন্দু পরিবারে তার জন্ম হয়। তার পিতার নাম সিন্নাসামি মুত্তিয়া ও মা লক্ষ্মী মুত্তিয়া চার ভাইয়ের পরিবারে তিনি বড় ছেলে।

মুত্তিয়া মুরালিধরনের পিতামহ, পেরিয়াসামি সিনসামি, ১৯২০ সালে মধ্য শ্রীলঙ্কার চা বাগানে কাজ করতে দক্ষিণ ভারত থেকে শ্রীলংকায় এসেছিলেন। সিনাসামি পরে তার কন্যাদের সাথে তার দেশে ফিরে আসেন এবং ভারতের তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীতে বসতি স্থাপন করেন।

[ মুত্তিয়া মুরালিধরন : দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম ]

তবে, মুরালিধরনের বাবা মুত্তিয়া সহ তার ছেলেরা শ্রীলঙ্কায় থেকে যান। তার বাবা সেখানে একজন সফল ব্যাবসায়ী তার বিস্কুটের ফ্যাক্টরি রয়েছে যা তিনি সফলভাবে পরিচালনার মাধ্যমে আরো প্রসারিত করেছেন।

মুরালিধরন ২১ মার্চ ২০০৫ সালে ভারতের চেন্নাইয়ের বাসিন্দা মাধীমালার রামামূর্তিকে বিয়ে করেন, মাধীমালার রামামূর্তির পিতা ছিলেন প্রয়াত ডাঃ এস. রামমূর্তি যিনি ছিলেন মালার হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার আর তার স্ত্রীর নাম ডাঃ নিথ্যা রামমূর্তি। মুরালিধরন ২০০৬ সালে প্রথম সন্তানের পিতা হন তার ছেলের নাম রাখেন নরেন মুরালিধরন।

 

Cricket GOLN-Website Logo-01

 

যখন তার বয়স নয় বছর, মুরালিধরনকে ক্যান্ডির সেন্ট অ্যান্থনি কলেজে দেয়া হয়, যেটি বেনেডিক্টাইন সন্ন্যাসীদের দ্বারা পরিচালিত একটি বেসরকারি স্কুল। সেখানে তিনি একজন মাঝারি পেস বোলার হিসেবে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন কিন্তু তার স্কুল কোচ সুনীল ফার্নান্দোর পরামর্শে তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে অফ-স্পিন অনুশীলন করতে শুরু করেন।

তার বোলিংয়ে কোচ সুনীল ফার্নান্দো শীঘ্রই মুগ্ধ হন এবং স্কুলের প্রথম একাদশে চার বছর তাকে খেলানো হয় । মুরালিধরন তখন অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেট খেলতেন এবং মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন। সেন্ট অ্যান্টনি’স কলেজে তার শেষ দুই মৌসুমে তিনি একশোর বেশি উইকেট নিয়েছিলেন এবং ১৯৯০/৯১ সালে ‘বাটা স্কুলবয় ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হন।

এরপর তিনি শ্রীলংকার তামিল ইউনিয়ন ক্রিকেট এবং অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কার ইংল্যান্ড সফরের জন্য নির্বাচিত হন। সেখানে পাঁচটি ম্যাচ খেলে তিনি একটিও উইকেট অর্জন করতে পারেন নি।

জন্মগত ভাবে তার হাতের হাইপার এক্সটেনশন এর কারণে মুরালিধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ার কিছুটা বিতর্কের মধ্যে পরে যখন তার বোলিং একশন নিয়ে বিভিন্ন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ ও আম্পায়াররা প্রশ্ন তোলেন। তাকে তার ক্যারিয়ারে মোট ২ বার ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালে সিমুলেটেড প্লেয়িং কন্ডিশনের অধীনে বায়োমেকানিক্যাল বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল তার বোলিংকে স্বীকৃতি দেয়।

 

Cricket GOLN-Website Logo-01

 

তবে, মুরালির ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে সফলতার পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এক সময়ের শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

কিছু ক্রিকেটীয় মাফিয়ার বেড়াজালে আটকে অচিরেই শেষ হতে পারত তার ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার। গল্পের শুরু ১৯৯৫ সালে। মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ করেছিলেন মুরালি। সে সময় আইসিসির একটা নিয়ম ছিলো যে, বোলিং করার সময় বল হাত থেকে ছাড়ার সময় হাত নিচু করা যাবে না। কিন্তু তখন প্রযুক্তি তেমন একটা উন্নতর না থাকার কারণে বোলারের বোলিং করার সময়ে সে সিদ্ধান্ত আম্পায়ারকেই নিতে হতো।
১৯৯৫ সাল, মেলবোর্ন টেস্ট। আম্পায়ার ছিলেন ডেরেল হেয়ার। মুরালি যখন বোলিং করতে আসলেন, তখনই আম্পায়ার ডেরেল হেয়ার মুরালির বোলিং একশনকে সন্দেহজনক ঘোষণা করে একের পর এক নো বল দিতে শুরু করে। শুধু ডেরেল হেয়ার নয়, এরপরেও বেশ কিছু ম্যাচে আম্পায়ার এমারসন তার বোলিং একশনকে অবৈধ বলে তার বলে একের পর এক নো বল ঘোষণা করতে থাকেন। এরপর এলো সাল ১৯৯৮।
মুত্তিয়া মুরালিধরনঃ দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম
প্রতিবাদ করছেন রানাতুঙ্গা

 

১৯৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা, যে জয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন মুরালি। ইতোমধ্যে আইসিসির দেয়া বোলিং একশন টেস্টে কার্যকর হন মুরালি যার মাধ্যমে আইসিসির দ্বারা তার বোলিং একশন একদম বৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পুনরায় একটি ওয়ানডে ম্যাচে আবারও মুরালির বোলিং একশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং পুনরায় মুরালির বোলিং করা বোলিংয়ে একের পর এক নো বল ঘোষণা দিতে থাকেন।
মুত্তিয়া মুরালিধরনঃ দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম
২০০৩ বিশ্বকাপে মুরালি

 

কিন্তু এবার আর কোনো প্রকার অন্যায় সহ্য করলেন না আর্জুনা। তিনি ম্যাচের মধ্যেই আম্পায়ারের সে দৃষ্টিকটু আম্পায়ারিং দেখে ম্যাচটি বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে পুরো টিম নিয়ে ম্যাচ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর আম্পায়াররা এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বড় কর্তারা অনেক চেষ্টার পর ম্যাচটি আবারো মাঠে গড়ায়।

আর্জুনার ধারণা ছিলো এই যে, যেহেতু পুরো বিশ্বে মুরালির বোলিং নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তাহলে মাত্র দুইজন আম্পায়ারকে ভয় করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। এরপর মুরালির বোলিংয়ে আর কোনো প্রকার বাজে আম্পায়ারিং দেখা যায়নি। রানাতুঙ্গা যখন মুরালির সাথে এমন অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেন, তখন মুরালি শ্রীলঙ্কা দলের এক তরুণ খেলোয়াড়। যদি রানাতুঙ্গা ক্যারিয়ারের সবথেকে কঠিন সময়ে মুরালির পাশে না দাড়াতেন তাহলে সে তরুণ মুরালি আজকের স্পিন বোলিং কিংবদন্তী মুত্তিয়া মুরালিধারাণ হওয়ার আগেই হয়তো ফুরিয়ে যেতেন।

 

মুত্তিয়া মুরালিধরনঃ দ্য গ্রেটেস্ট স্পিনার অব অল টাইম
২০০৭ বিশ্বকাপে মুরালি

 

  • টেস্টে ৮০০ উইকেট যা তিনিই প্রথম ও অদ্বিতীয়।
  • একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনিই সর্বাধিক ৫৩৪ উইকেটের মালিক।
  • সবধরণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার উইকেট সর্বোচ্চ (টেস্ট, ওয়ানডে, টি ২০) মোট ১৩৪৭ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
  • টেস্ট পর্যায়ে এক ইনিংসে তিনি সবচেয়ে বেশিবার ৫ উইকেট শিকার করেছে (৬৭) বার।
  • সবথেকে বেশি দেশের বিপক্ষে তার এক ইনিংসে ৭ উইকেট শিকার রয়েছে (৫) পাঁচ দেশের বিপক্ষে।
  • প্রতিটি টেস্ট খেলা দেশের বিপক্ষে তার উইকেট প্রাপ্তি সর্বনিন্ন ৫০ বা তারও উপরে উইকেট নেন।
  • মুরালিধরন টেস্ট ক্রিকেটে সবচাইতে বেশিবার ম্যান অফ দা সিরিজের সম্মান পান।
  • একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বোলিংয়ে টানা চার টেস্ট ম্যাচে ১০ উইকেট নেন। এই কৃতিত্ব তিনি আরও একবার করেন মোট দুইবার।
  • আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সবথেকে বেশিবার ৫ উইকেট শিকার।
  • টেস্ট ইতিহাসের মাত্র ছয়তম বোলার একজন যিনি টেস্ট ম্যাচে ১১ টি উইকেট নিয়েছিলেন।
  • আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচাইতে বেশিবার বোল্ড আউট করা বোলার।
  • আন্তর্জাতিক খেলায় সবচাইতে বেশি বল করেছেন। মুরালিধরন মোট ৬৩১৩২টি বল করেছেন।
  • টেস্ট ক্রিকেটে সব বোলারের চাইতে বেশি বল করেছেন (৪৪০৩৯) বার।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment