দীর্ঘ এক মাসের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, রোমাঞ্চকর সুইং, এবং অসংখ্য নাটকীয় মুহূর্ত শেষে আজ পর্দা নামল নবম আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের আলোকোজ্জ্বল রাতে ক্রিকেটপ্রেমীরা প্রত্যক্ষ করল এক ঐতিহাসিক জয় — নিউজিল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে ভারত জিতে নিল তাদের তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শিরোপা।
২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে এবং ২০১৩ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবার ২০২৫ সালের এই জয় ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করল। এটি শুধু একটি শিরোপা নয় — বরং আধুনিক ক্রিকেটে ভারতের ধারাবাহিক সাফল্যের প্রতীক, যেটি প্রমাণ করে তারা শুধু একদিনের নয়, বরং বিশ্ব ক্রিকেটের ধারাবাহিক শক্তিশালী পরাশক্তি।
২০২৫ সালের আয়োজন ও প্রেক্ষাপট
এই আসরটি মূলত আয়োজিত হয়েছিল পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পাকিস্তান ছিল মনোনীত স্বাগতিক দেশ, কিন্তু নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে বেশ কয়েকটি ম্যাচ স্থানান্তরিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ফলে এবারের টুর্নামেন্টটি হয়ে ওঠে এক বহুজাতিক আয়োজন, যেখানে মরুপ্রান্তরের মঞ্চে বিশ্বের সেরা আট দল লড়াই করে গৌরবের মুকুটের জন্য।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ভারতীয় দল ছিল এক অনন্য সমন্বয়ের প্রতিচ্ছবি। ব্যাটিংয়ে রোহিত শর্মা ও শুভমন গিলের আগ্রাসী সূচনা, বিরাট কোহলির অবিচল দায়িত্ববোধ, এবং সূর্যকুমার যাদবের উদ্ভাবনী ব্যাটিং ছিল ভারতীয় ইনিংসের প্রাণ। অন্যদিকে বোলিং বিভাগে মোহাম্মদ শামি, বুমরাহ ও কুলদীপ যাদবের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স প্রতিপক্ষদের বিপাকে ফেলে দেয় বারবার।
ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৭৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভারতের ব্যাটসম্যানরা দেখান ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের এক অসাধারণ মিশ্রণ। কোহলির অনবদ্য ৮৭ রানের ইনিংস ভারতকে এনে দেয় কাঙ্ক্ষিত জয়, আর সাথে তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মুকুট।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাস: গৌরব ও পরিবর্তনের যাত্রা
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি প্রথম চালু হয় ১৯৯৮ সালে, মূলত বিশ্ব ক্রিকেটে তহবিল সংগ্রহ ও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই টুর্নামেন্টটি ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ওয়ানডে প্রতিযোগিতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এর বিশেষত্ব ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে শীর্ষ দলের লড়াই, যেখানে প্রতিটি ম্যাচই ছিল ‘করো না হয় মরো’ ধরনের।
নীচে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপদের তালিকা দেওয়া হলো —
| সাল | আয়োজক দেশ | চ্যাম্পিয়ন | রানার্স-আপ |
|---|---|---|---|
| ১৯৯৮ | বাংলাদেশ | দক্ষিণ আফ্রিকা | ওয়েস্ট ইন্ডিজ |
| ২০০০ | কেনিয়া | নিউজিল্যান্ড | ভারত |
| ২০০২ | শ্রীলঙ্কা | যৌথভাবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা | – |
| ২০০৪ | ইংল্যান্ড | ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ইংল্যান্ড |
| ২০০৬ | ভারত | অস্ট্রেলিয়া | ওয়েস্ট ইন্ডিজ |
| ২০০৯ | দক্ষিণ আফ্রিকা | অস্ট্রেলিয়া | নিউজিল্যান্ড |
| ২০১৩ | ইংল্যান্ড | ভারত | ইংল্যান্ড |
| ২০১৭ | ইংল্যান্ড | পাকিস্তান | ভারত |
| ২০২৫ | পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত | ভারত | নিউজিল্যান্ড |
ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থান ও আধিপত্য
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে ভারতের তিনটি শিরোপা কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং এক যুগান্তকারী যাত্রার প্রতীক। ২০০২ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ভারতীয় আধিপত্যের সূচনা; ২০১৩ সালে ধোনির কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এনে দেয় দ্বিতীয় সাফল্য; আর ২০২৫ সালে রোহিত-কোহলি যুগের যৌথ অভিজ্ঞতা দলটিকে আবারও গৌরবের শীর্ষে তুলে আনে।
ভারতীয় ক্রিকেট এখন এক সুনির্মিত কাঠামোর প্রতীক — যেখানে মেধা, পেশাদারিত্ব ও অবকাঠামোগত শক্তি একত্রে মিশে গেছে।
দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেট, আইপিএলের প্রতিযোগিতা, এবং তরুণ প্রজন্মের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ এই সাফল্যের ভিত মজবুত করেছে।
বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের নতুন বার্তা
২০২৫ সালের এই জয় শুধু একটি শিরোপা নয়; এটি একটি ঘোষণা — যে ভারত এখন বিশ্ব ক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দু।
তাদের টেকনিক, মনোবল, নেতৃত্ব ও গভীরতা প্রমাণ করেছে যে তারা কেবল স্বল্পমেয়াদী জয় নয়, দীর্ঘমেয়াদে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রস্তুত।
এই জয় বিশ্ব ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এক অনুপ্রেরণার গল্প — যেখানে কঠোর পরিশ্রম, ঐক্য ও আত্মবিশ্বাস একসঙ্গে সাফল্যের ইতিহাস গড়ে।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ২৭ বছরের ইতিহাসে বহু দল এসেছে, জিতেছে, হেরেছে—কিন্তু ধারাবাহিকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে ভারত নিজেকে আলাদা উচ্চতায় স্থাপন করেছে।
২০২৫ সালের ট্রফি জয় সেই গৌরবগাথার সর্বশেষ অধ্যায়, যা ভবিষ্যতের ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
শুভেচ্ছা ভারতকে — চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নতুন রাজা!
