কেভিন পিটারসেন, এক সময়ের ইংলিশ ক্রিকেটের হার্টবিটের নাম। ২০০৫ অ্যাশেজে পিটারসেন দ্বারা অজি বোলারদের তুলোধুনো করা যেনো সে সময়ের ক্রিকেট ভক্তদের চোখে আজও লেগে আছে। জন্মভূমি নাটালের হয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে পিটারসেনের।
এর পরেই তিনি ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত হন। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় ইংল্যান্ড। সেই সফরে তিনদিনের এক প্রস্তুতি ম্যাচে পিটারসেনের কোয়াজুলু নাটাল মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। চারদিনের সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে দারুণ কিছু শটে ৫৭ বলে ৬১ রানে অপরাজিত থাকেন পিটারসেন। সেদিন নয় নম্বরে ব্যাট করেন তিনি। বল হাতেও ছিলেন উজ্জ্বল।
তার বলেই আউট হয়েছিলেন নাসের হুসাইন, মাইকেল আথারটন, মাইকেল ভনের মতো ব্যাটসম্যানরা। ব্যাটে-বলে এমন পারফরম্যান্সের পর নাসের হুসাইন নিজে থেকেই পিটারসেনের সঙ্গে কথা বলেন। পরামর্শ দেন ইংল্যান্ডের কোনো কাউন্টির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার। নাটালে আরো দুই মৌসুম খেলে পিটারসেন পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কোটা প্রথার কারণেই এই প্রস্থান। নিয়ম ছিল একাদশে কমপক্ষে চারজন কৃষাঙ্গ ক্রিকেটার থাকতে হবে। যার কারণে নাটালের ‘এ’ টিম থেকে বাদও পড়েছিলেন পিটারসেন। তার দাবি ছিল, মেধা দিয়েই বিচার হোক, কোনো কোটা দিয়ে নয়। তাই ক্লাবের সাথে বিচ্ছেদ। ইংল্যান্ডের ক্যানক ক্রিকেট ক্লাব হয় তার নতুন ঠিকানা। মা ব্রিটিশ হওয়ায় সেখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়নি।
প্রথমবারের মতো পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা। থাকতেন একটা রুম নিয়ে, যেটার ঠিক ওপরেই একটা স্কোয়াশ কোর্ট। খেলার পাশাপাশি কাজ করতেন একটা বারেও। এপ্রেক্ষিতে তিনি জাতিগত কোটা পদ্ধতিতে তার অসন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করেন। তার ইংরেজ মা ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলার উপযোগী করে তোলেন। এর যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাকে চার বছর কাউন্টি পর্যায়ের খেলায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।
এর পরপরই তিনি দ্রুত জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য ডাক পান। ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে দলের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত একদিনের আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে পিটারসনের। এর পরের বছর ২০০৫ সালের অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি।
কেভিন পিটারসেন এক সময়ের ইংলিশ ক্রিকেটের হৃদস্পন্দন
জুন, ২০০৯ সালে লাফবোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুশীলনী চলাকালে উদীয়মান রিস টপলির বোলিংয়ে আহত হন। এরপর পিটারসনকে দ্রুত লিচেস্টার রয়্যাল ইনফার্মারিতে প্রেরণ করা হয় এবং তার কানে সেলাই করতে হয়। এ ঘটনার পর টপলি’র আদর্শ পিটারসন তাকে স্বাক্ষর সংবলিত ব্যাট উপহার দেন।
ইংল্যান্ড দল পিটারসনের ধারাবাহিক সাফল্যে উজ্জ্বীবিত হয়ে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ঘরোয়া ক্রিকেটে হ্যাম্পশায়ারের পক্ষে তাকে শুধুমাত্র একটি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।
১৭ জুন, ২০১০ তারিখে পিটারসন ঘোষণা করেন যে, তিনি হ্যাম্পশায়ার থেকে চলে যেতে ইচ্ছুক।এর পরপরই তিনি সারে দলের হয়ে ধারকৃত খেলোয়াড় হিসেবে বাকী মৌসুম চালিয়ে যান ও ২০১১ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ঐ দলে যোগ দেন।টেস্ট ক্রিকেট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পিটারসন অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
৪ আগস্ট, ২০০৮ থেকে ৭ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখ পর্যন্ত ইংরেজ অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি মাত্র তিনটি টেস্ট ও নয়টি ওডিআইযে অংশ নেন। দায়িত্ব থেকে অব্যহতিকালে একইদিনে ইংল্যান্ডের কোচ পিটার মুরেজও অব্যহতি নেন। ইসিবি’র সাথে তার সম্পর্কের তেমন উত্তোরণ ঘটেনি।
২০১২ সালে সময়সূচীর সাথে একাত্মতা পোষণ না করায় ৩১ মে তারিখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সকল ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে তিনি অবসরের চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে সরে আসেন এবং ইসিবি ও দলীয় খেলোয়াড়দের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সিরিজে।
তবে, তিনি সিরিজের চূড়ান্ত টেস্টে দল থেকে বাদ পড়ে যান। ২০০৯ সালের শুরুতে ভারত সফরে টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিকে সিরিজ হারলে ইসিবি ইংল্যান্ড অধিনায়ক কেভিন পিটারসনকে জরুরী সভায় তলব করে ও দলে মুরেজের কোচিংয়ের মান ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পরদিন পিটারসন গণমাধ্যমে ঐ সভায় দলের ‘অস্বাস্থ্যকর অবস্থার’ কথা তুলে ধরেন ও শীঘ্রই মুরেজকে কোচের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে বলে জানান।দলের প্রশিক্ষণ, সম্ভাব্য ও সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনকে সামনের ওয়েস্ট সফরে অধিনায়ক হিসেবে মনোনয়ন ইত্যাদি বিষয়ে মুরেজ ও পিটারসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো।
ফলশ্রুতিতে ৭ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে মুরজে কোচের দায়িত্ব থেকে ইসিবি অব্যহতি দেয় ও পিটারসন অধিনায়ক থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের অব্যবহিত পরই ইংরেজ ক্রিকেটের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন ধারাভাষ্যকার মনে করেন, মুরেজের পদত্যাগের বিষয়ে পিটারসন উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।
কয়েকদিন পর এক স্বাক্ষাৎকারে পিটারসন জানান যে, অধিনায়কের পদ থেকে অব্যহতির ইচ্ছে না থাকলেও ইসিবি কর্মকর্তাগণ তাকে পদচ্যুতির কথা জানিয়েছিলেন।তবে, ইসিবি’র সহ-সভাপতি ডেনিস অ্যামিস পিটারসনের বক্তব্যকে উদ্বৃতি দিয়ে জানান যে, মুরেজের পদত্যাগের বিষয়টি তিনি ফাঁস করেননি। অ্যামিস বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না যে, কেভিন পিটারসন তথ্য ফাঁস করেছেন।’
দলের অধিনায়কের দায়িত্বে অ্যান্ড্রু স্ট্রসের নাম পরবর্তীকালে ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১০ সালে তার ব্যাটে ভর করেই নিজদের প্রথম টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি জেতে ইংল্যান্ড। সে বিশ্বকাপে ৬০ গড়ে রান করেছিলেন তিনি।
কেভিন পিটারসেন তার নয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেই পেছনে ফেলেছিলেন অনেক ইংলিশ ক্রিকেটীয় কিংবদন্তীকে। ওয়ালি হ্যামন্ড, টেড ডেক্সটার, পিটার মে’র চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন। টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছেন জিওফ্রে বয়কট-ডেভিড গাওয়ারের চেয়ে বেশি গড় নিয়ে।
সেঞ্চুরিতে পেছনে ফেলেছেন গ্রাহাম গুচ, লেন হাটন, কেন বেরিংটনের মতো ক্রিকেটারদের। এটা কোনো তুলনা নয়, কেবল দেখানোর চেষ্টা এতটুকুই – নয় বছরের ক্যারিয়ারে এত অর্জন যার, যদি আরেকটু নিজেকে সামলে রাখতেন, তাহলে বোধহয় ক্রিকেট বিধাতা আরো দারুণ কিছু তুলে দিতেন তার পাতে।
আরও পড়ুন: