পাকিস্তানের কিংবদন্তী ক্রিকেটা্র ইনজামাম উল হকের খেলা প্রতিটি শটেই যেনো লেজি এলিগেন্সের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতো। ইনজমামের ক্রিকেটীয় শৈলীতে যেমন ক্রিকেট ভক্তরা তার খেলা শটগুলোর প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। তবে, ইনজামাম শুধু একজন স্টাইলিশ ব্যাটারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিপদে দলের কান্ডারি এবং একজন দায়িত্বশীল অধিনায়কও। বরং, অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর ইনজামামের ব্যাটিং গড় আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

পাকিস্তানের মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন ইনজামাম-উল-হক। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কিছুটা শান্ত আর লাজুক প্রকৃতির ইনজামামের ছিলো ক্রিকেটের বড্ড নেশা।
‘ইঞ্জি’ ডাকনামে পরিচিত এই নাদুসনুদুস আরামপ্রিয় ছেলেটিই কালক্রমে একদিন হয়ে উঠল ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান, অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সফল অধিনায়ক।
[ ইনজামাম উল হক : দ্যা বিউটি অব লেজি এলিগেন্স ]
একদিনের আন্তর্জাতিকে জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ইনজামাম টেস্ট ক্রিকেটে জাভেদ মিয়াঁদাদের পরেই অবস্থান করছেন। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল মেয়াদে তিনি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের টেস্ট, ওডিআই এবং টি২০ ক্রিকেটের অধিনায়ক ছিলেন। অধিনায়কের ক্ষেত্রেও তিনি সফলকাম। ইনজামামকে সেদেশের সেরা অধিনায়কদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইমরান খানের অধিনায়কত্বে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা বিজয়ী পাকিস্তান দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন ইনজামাম।
ইনজামাম উল হকের ক্রিকেটে হাতেখড়ি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জন্মস্থান মুলতানের হয়ে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হয় ইনইজামামের।
ইনজামাম উল হকের ওয়ানডে অভিষেক হয় মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৯১ সালের নভেম্বরে ,দেশের মাটিতে। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ২০ রান করে আউট হলেও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন এরপরের ম্যাচেই, খেলেছিলেন ৬০ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস। ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচেই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত বল হাতে নিয়েছিলেন ইনজি আর প্রথম বলেই পেয়েছিলেন ব্রায়ান লারার উইকেট।
এরপর, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫ ম্যাচের একটি ওয়ানডে সিরিজ খেলেন ইনজামাম। সেখানেও, চমকপ্রদ ব্যাটিং পারফর্মেন্সের প্রদর্শন করেন তিনি। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে চার ইনিংসে দুই সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিসহ তুলে নেন ৩২৬ রান। ফলে তাঁর বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাওয়াটা একরকম অবধারিতই ছিল। ক্যারিয়ারের প্রথম ৬টি একদিনের ম্যাচে ইনজামামের সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ২০, ৬০, ৪৮, ৬০, ১০১ ও ১১৭ রান। যেখানে তার ব্যাটিং গড় ছিল ৬৭.৬৭ এবং স্ট্রাইক রেট ছিল ৮৭.৬৩।
১৯৯২ বিশ্বকাপেও পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ইনজামাম উল হক। বিশ্বকাপের রাউন্ড রবিন লিগে ইনজামামের পারফরম্যান্স ছিল বেশ হতাশাজনক। ৮ ম্যাচে ১৫.৩৭ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১২৩ রান! তবুও অধিনায়ক ইমরান খান আস্থা রেখেছিলেন ২২ বছরের প্রতিভাবান এই তরুণের ব্যাটিং সামর্থ্যের ওপর। কেননা ইমরান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, মুলতানের এই ছেলেটি যেকোন মুহূর্তে ম্যাচের রঙ বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বিশ্বকাপ অভিষেকেই ইনজামাম-উল-হকের উত্থানটা ছিল অনেকটা রূপালি পর্দার নায়কদের মত। সেমিফাইনাল ও ফাইনালের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দুটি ম্যাচে অসাধারণ দুটি ইনিংস দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সেই পেয়ে যান ন্যাশনাল হিরোর খেতাব।
১৯৯২ সালের জুনে এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। তবে অভিষেকে বলার মত কিছুই করতে পারেননি ইঞ্জি। সে ম্যাচে, তেমন কিছু করার সুযোগই পাননি তিনি। সে ম্যাচের মাত্র এক ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে অপরাজিত থাকেন ৮* রানে।
মূলত, ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল এবং ফাইনাল ইনজামামের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এ বিশ্বকাপের পরে ইঞ্জিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১২০ টেস্টে ইনজামাম করেছেন ৪৯.৬০ গড়ে ৮৮৩০ রান। ২৫টি শতরানের পাশাপাশি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ৪৬টি। আছে ২টা ডাবল আর ১টা ট্রিপল সেঞ্চুরিও। চার মেরেছেন ১১০৫টি এবং ছক্কা ৪৮টি। সর্বোচ্চ ইনিংস ৩২৯ রান, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
৩৭৮টি একদিনের ম্যাচ খেলে তাঁর সংগ্রহ ১১৭৩৯ রান। ব্যাটিং গড় ৩৯.৫৩, স্ট্রাইক রেট ৭৪.২৫। ১০টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৮৩টি। চার মেরেছেন ৯৭০টি এবং ছক্কা ১৪৪টি। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৩৭* রান, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
ইউনুস খান (১০,০৯৯) ও জাভেদ মিয়াঁদাদের (৮৮৩২) পর টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেন ইনজামাম-উল-হক।

আর ওয়ানডেতে এখনও পর্যন্ত ইনজামামই পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান। পাকিস্তানের হয়ে মোট ৩০টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইনজামাম। জিতেছেন ১১টি, হেরেছেন ১০টি আর ড্র হয়েছে ৯টি টেস্ট।
ক্যাপ্টেন্সির একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে। অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় (৫২.৮৩) ক্যারিয়ার গড়ের (৪৯.৬০) চাইতে তুলনামূলক বেশি। ওয়ানডেতেও প্রায় একই অবস্থা।
ওয়ানডে ইতিহাসে অধিনায়কের ভূমিকায় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় এবি ডি ভিলিয়ার্স (৬৫.৯২) ও মহেন্দ্র সিং ধোনির (৫৩.৯৩) ঠিক পরের স্থানটিতেই আছেন ইনজামাম-উল-হক (৪৩.৮৯)।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন পাঁচ নম্বরে। এই পজিশনে অন্তত ১০০ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইনজামামের গড়ই সবচেয়ে বেশি। তিনি পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন মোট ১০৫ ইনিংসে। ৪১.৮৪ গড়ে করেছেন ৩৪৭৩ রান।

শচীন টেন্ডুলকার (৯৬), কুমার সাঙ্গাকারা (৯৩) ও জ্যাক ক্যালিসের (৮৬) পর ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বাধিক ফিফটির মালিক ইনজামাম-উল-হক (৮৩)। শচীন টেন্ডুলকারের পর ওয়ানডেতে ১০,০০০ রানের মাইলফলক অতিক্রমকারী দ্বিতীয় ব্যাটসম্যানের নাম ইনজামাম-উল-হক।
আরও দেখুনঃ
“ইনজামাম উল হক : দ্যা বিউটি অব লেজি এলিগেন্স”-এ 1-টি মন্তব্য