ঢাকা, ২৮ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ঘিরে ফের নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তার আয়কর হিসাব, সম্পদের উৎস ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা পড়েছে।
এই আবেদন করেছেন ব্যারিস্টার মিলহানুর রহমান নাওমী, যিনি বুধবার (২৮ আগস্ট) দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদনপত্র জমা দেন। এতে সাকিবের বিরুদ্ধে একাধিক আর্থিক অনিয়ম, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগের তদন্ত দাবি করা হয়েছে।
আয়কর হিসাব ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সাকিবের বিরুদ্ধে দুদকে আবেদন
আবেদনের বিষয়বস্তু: একাধিক অভিযোগের বিশদ তালিকা
আবেদনে সাকিব আল হাসানকে “সাবেক সংসদ সদস্য ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি” হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,
“তার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগৃহীত আয়, সম্পদের উৎস, এবং তৎসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”
এতে আরও বলা হয়েছে—
“অপরাধলব্ধ আয় স্থানান্তর, হস্তান্তর, রূপান্তর এবং মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের পাশাপাশি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ অনুসন্ধান করা দরকার।”
আবেদনে অন্তর্ভুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের তালিকা হলোঃ
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ,
নিষিদ্ধ জুয়া ব্যবসা এবং বিদেশি বেটিং কোম্পানির সঙ্গে আর্থিক সম্পৃক্ততা,
স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ,
ক্রিকেট সংক্রান্ত দুর্নীতি ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ,
নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদের তথ্য ও আয়ের উৎস গোপন করা।

দুদকের কাছে দাবি: অনুসন্ধান ও মামলা দায়ের
আবেদনপত্রে অনুরোধ জানানো হয়েছে,
“উল্লিখিত অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতে দুদক যেন অবিলম্বে অনুসন্ধান শুরু করে, প্রয়োজনবোধে মামলা দায়ের করে, এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।”
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আবেদনটি গৃহীত হয়েছে এবং প্রাথমিক যাচাইয়ের জন্য সংস্থার অনুসন্ধান শাখায় পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
একজন দুদক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আবেদনটি আমরা পেয়েছি। বিষয়টি প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে। প্রয়োজনে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে।”

সাকিব আল হাসানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
এই অভিযোগ এমন সময় এল যখন সাকিব মাঠে দারুণ পারফর্ম করছেন। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে বল হাতে ৫ উইকেট ও ব্যাট হাতে অর্ধশতক হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় টেস্টের আগেই তাকে নতুন এক আইনি বিতর্কের মুখোমুখি হতে হলো।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গার্মেন্টস কর্মী রুবেল হত্যার মামলায়ও সাকিবের নাম উঠে আসে। সে মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছিল।

কর ও সম্পদের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন
সাকিবের সম্পদ নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন উঠেছে। তিনি শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটার নন, বরং একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফ্র্যাঞ্চাইজি দল, এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। তার মালিকানাধীন Monarch Mart, Burak Commodities, ও SS Holdings নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক লেনদেন নিয়েও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের কর কর্তৃপক্ষ (NBR) একাধিকবার ক্রিকেটারদের আয়কর ফাইল অডিট করেছে। সাকিব সেসব অডিটে সহযোগিতা করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। তবে দুদকের এই নতুন আবেদন বিষয়টিকে আবারও আলোচনায় এনেছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
আবেদনটি প্রকাশ্যে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদল ব্যবহারকারী দুদকের পদক্ষেপকে “গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী” বলেছেন, অন্যদিকে অনেকে এটিকে “ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলেও দাবি করেছেন।
একজন সাবেক ক্রিকেট বোর্ড কর্মকর্তা বলেন—
“সাকিব দেশের অন্যতম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তার বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হওয়া উচিত, তবে কোনো পক্ষপাত ছাড়া।”
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সাকিব আল হাসান এক অনন্য নাম—তার মাঠের পারফরম্যান্স, নেতৃত্ব ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি তাকে দেশসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে সাম্প্রতিক এই অভিযোগ ও আইনি প্রক্রিয়া তার ক্যারিয়ার ও জনমত—দুই দিকেই নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে।
এখন সবার নজর দুদকের দিকে—তারা কি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করবে? নাকি এটি আরেকটি আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
সময়ের অপেক্ষায় ক্রিকেটপ্রেমীরা।